Wednesday 14 October 2020

পশু কাহিনী-০২: শেং ডু-র আঁকা জিরাফ

    বর্তমান মালদা জেলার পাণ্ডুয়ার গৌরবময় ইতিহাস বুঝতেে হলে ওখানকার ধ্বংসস্তূপ দেখতে হয়। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝখান পর্যন্ত শাহী বাংলার রাজধানী ছিল পাণ্ডুয়া। পরে রাজধানী গৌড়ে স্তানান্তারিত হয়, এবং পাণ্ডুয়া পরিত্যক্ত হওয়ায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। চীন দেশে তখন কুবলা খাঁ-র ইউয়ান রাজবংশের সাম্রাজ্য শেষ হয়ে হান রাজাদের মিং বংশের সাম্রাজ্য শুরু হয় নানজিং শহরকে কেন্দ্র করে। আফ্রিকার কেনিয়া দেশের প্রাচীনতম শহর, মোম্বাসা-র, থেকে ১০০ কি.মি. দূরে সমুদ্রতটেরই আরেক শহর মালিন্দি। মালিন্দি, পাণ্ডুয়া ও নানজিং—এই তিন শহরকে ১৪১৪ সালে জুড়ে ফেলেছিল একটি জিরাফ।
    শাহী বাংলা তখনকার বস্ত্রশিল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। ভারতের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে ব্যবসা ছাড়াও, পশ্চিম দিকে আরব দেশ ও আফ্রিকার সঙ্গে, ও পূর্ব দিকে এশিয়ার অন্যান্য কিছু দেশ যেমন চীনের সঙ্গেও শাহী বাংলা ব্যবসা করতো। ব্যবসা রমরমা হলেও রাজনৈতিক স্তিতিশীলতা ছিলনা। ঘনঘন ইলিয়াস শাহী বংশের রাজা পরিবর্তন হচ্ছিল। এরকমই এক সময় এসে পৌঁছায় মালিন্দি থেকে আসা এক দল রাজদূত ও ব্যবসায়ীরা ইলিয়াস শাহী রাজার জন্য তোফা নিয়ে। একটি তোফা একখানা জিরাফ।
    জিরাফ মানুষের পক্ষে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া একবিংশ শতাব্দীতেও কঠিন এবং মাঝে মাঝে পশুশালার আদান-প্রদানের মধ্যে জিরাফ হস্তান্তর করতে গিয়ে তারা মারা যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে যাত্রাটা আরো নিশ্চই কঠিন ছিল। আফ্রিকার বাইরে জিরাফ আগেও পাঠানো হয়েছিল। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টপূর্বে জিরাফ মাঝে মধ্যেই আফ্রিকা থেকে পাঠানো হতো। রোমান সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ততেও জিরাফ পাঠানো হতো। পশ্চিম এশিয়ার একাধিক এলাকায় প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সময়কার মোসেইকে পাওয়া যায় জিরাফের চিত্র। তবে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অবনতির পর, পশ্চিম ইউরোপে ত্রোয়দশ শতাব্দীর আগে আর জিরাফ দেখা যায়নি। প্রাচীন গ্রীস ও রোমের গ্রন্থে জিরাফের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সব গ্রন্থে এই পশুর নাম ছিল ক্যামেল-লোপার্ড, উঁট-চিতা বাঘ, কারণ পশুটি প্রথমটার মত লম্বা ও দ্বিতীয়টার মত তার গায়ে ছোপ।
    ভারতবর্ষে জিরাফ প্রথম কবে আফ্রিকা থেকে আনা হয়, তার হদিশ পাওয়া মুশকিল। ত্রোয়দশ শতাব্দীতে নির্মিত কোনার্ক সূর্য মন্দিরের গায়ে জিরাফের খোদাইচিত্র দেখা যায়। তবে চীনে প্রথম জিরাফ নিয়ে যাওয়া হয়ে সেই ১৪১৪ সালেই। চীনের অভ্যন্তরিন সমস্যায় জর্জরিত মিং রাজারা চীনের বাইরের জগতের সঙ্গে ব্যবসায় খুব বেশি ইচ্ছুক ছিলনা। তবে পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে চীনের রাজা হয় শু দি যে ইয়ংলে নাম অবলম্বন করে। ইয়ংলে চীনের ইতিহাসে নানান পরিবর্তন ঘটায়। নানজিং থেকে বেইজিং-এ নিজের রাজধানী সরিয়ে আনে। সমুদ্র পথে ব্যবসা করার মহান পরিকল্পনা করে। চীনে বহুকাল ধরেই রীতি ছিলো শত্রুদের যৌনাঙ্গ কেটে দেওয়ার। এই অত্যাচার করা বালকদেরই আবার পরে মন্ত্রিসভায় জায়গা হতো। ভাবা হতো, এদের যেহেতু প্রজননক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছে, ফলে এরা রাজাকে টপকে নিজের রাজত্ব স্তাপন করার চেষ্টা করবে না কারণ তাদের কোনো উত্তরাধিকার থাকবে না। এরকম একজন বালক ছিল মা হে যাকে পরে রাজা নাম দিয়েছিল জেং হে। জেং হে রাজার সবচেয়ে বিশিষ্ট কর্মচারীরাদের মধ্যে জায়গা তৈরি করে নেয়ে। ১৪০৫ থেকে শুরু করে ১৪৩৩ পর্যন্ত জেং হে জাহাজে করে সাতখানা অভিযান চালায় পৃথিবীর নানা দেশে। সেই অভিযানের মাত্রা চীনের শক্তি ও মাপের সঙ্গে মানানসয়ী ছিল। সেই শতাব্দীর শেষে যখন ক্রিস্টোফার কোলাম্বাস যাত্রা শুরু করে, তার দলে ছিলো নব্বইয়ের কাছাকাছি মানুষ। জেং হে-র ছিল পয়ত্রিশ হাজার। জেং হে-র সব চেয়ে বড় জাহাজ কোলাম্বাসের সব চেয়ে বড় জাহাজের চেয়ে প্রায় কুড়ি গুন বড় ছিল। এরকমই এক চৈনিক অভিযান ১৪১৪-তে এসে পৌঁছায় বাংলার পাণ্ডুয়া তে। জেং হে-র মূল অভিযানের থেকে কিছু নাবিক আলাদা ভাবে পাণ্ডুয়া এসে পৌঁছোয়। সেখানে তখন মালিন্দি থেকে আসা জিরাফ-ও রয়েছে। সেই জিরাফ দেখে চীন থেকে আসা মানুষেরা হতভম্ব হয়ে যায়। চীন ও আফ্রিকার মধ্যে ক্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিলো ভারতের কেরলের থেকে ত্রোয়দশ শতাব্দীতে আফ্রিকার জিব্রা ও টোপি চীনের জাহাজে করে চীনদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে চীনের মানুষেরা আগে জিরাফ দেখেনি। তাদের প্রাচীন লোককথায় কিইলিন নামক এক পশুর কথা আছে (যা অনেকেই পাশ্চাত্যের ইউনিকর্ণের সঙ্গে জোড়ে)। এদের মনে হলো এই তো সেই কিইলিন! শিগ্‌গির নানজিং-এ মহারাজের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তবে মালিন্দির মানুষেরা তো এই জিরাফ ইলিয়াস শাহী বাংলার সুলতানকে দিয়েছিল। ফলে, বাংলার সুলতানকে বলা হলো যে এই পশু তাদের চীনের ধর্মে পবিত্র, যেমন পবিত্র ড্র্যাগান, ফিনিক্স ও কচ্ছপ। সুলতান চীন থেকে আসা যাত্রীদের তাদের রাজার জন্য এই তোফা পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু, চৈনিকরা ভাবলো আরেকটা জিরাফ হলেও মন্দ হয় না। ফলে, মালিন্দি থেকে আসা মানুষদের কাছে অনুরোধ জানানো হলো আরেকটা জিরাফের। জেং হে চীনে সেই বার ফেরৎ যাওয়ার পর, তার পরের যাত্রায় আফ্রিকা পর্যন্ত যায় এবং মালিন্দিতে যেতে ভোলেনি। ১৪১৪-এর এবং ১৪২১-এর চৈনিক যাত্রা থেকে চীনের নাবিকেরা নিজেদের রাজাকে দুই দুটো জিরাফ উপহার দিতে পেরেছিলো। প্রথম জিরাফটি পাওয়ার পরই রাজা ইয়ংলে এই অদ্ভূত জীবের একটি চিত্র বানিয়ে রেখেছিলো নিজের চারুলিপিকর শেন ডু-কে দিয়ে। সেই চিত্র আজ আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের এক যাদুঘরে। তবে, সেই চিত্র থেকে আফ্রিকা, বাংলা ও চীন-এর মধ্যে এক জিরাফ-যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
    চিত্রটিতে দেখা যায় একটি জিরাফ ও তার দেখাশোনা করার এক লোককে। জিরাফের গায়ের দাগ ছোপ ছোপ না হয়ে, ত্রিকোণা ঢেউয়ের মত হয়ে গেছে। চীনের প্রবাদে যখনই কোন দয়ালু, শক্তিশালী ও ভালো রাজা থাকবেয়, স্রেফ তখনই কিইলিনের দেখা পাওয়া যাবে। চিত্রটি রাজশক্তির প্রমাণ—তাদের রাজার কাছে দুরূহ প্রাণীও আশ্রয় নেয়। সেই দুরূহ প্রাণীটিকে সাধারণ মানুষকেও চিনতে হবে। রাজা আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলো যে এই প্রাণীই কিইলিন, নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করার জন্য। কিইলিনকে ইউনিকর্ণের সঙ্গে একই ভাবে ভাবা হয়। ইউনিকর্ণ মানেই তার একটা শিং। তবে, জিরাফের দুটো শিং এবং শেন ডু-র চিত্রের জিরাফের-ও দুটো শিং। ফলে, জিরাফ-ই কিইলিন কি না চীনের মানুষের মধ্যে এই সংশয় থেকে থাকতেই পারে।
    গণ্ডার ও জিরাফ—এই দুই পশুকেই কোন এক কালে ইউনিকর্ণ ভাবা হতো। এখন অনেকে বলে যে নারওয়াল নামক সামুদ্রিক জীবের শিং-কেই আগে অনেকে ইউনিকর্ণের শিং বলে চালাতো। গণ্ডার ভারতেও পাওয়া যায়, তাই আমরা এই পশুটিকে ইংরিজি নাম, রাইনোসেরাস, ছাড়াও অন্য নামে জানি। জিরাফ ভারতে ইংরেজদের আসার আগে থেকেই আরব ও আফ্রিকার মানুষেরদের থেকে আমরা চিনেছি। তবে জিরাফ ভারতে বহু কোটি বছর ধরেই পাওয়া যায় না। ফলে, জিরাফ চিরকালই ভারতে বিদেশী পশু। ইংরেজদের আসার পরই জিরাফ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে ভারতে আগের থেকে। ফলে, ইংরেজদের ব্যবহার করা নাম ধরেই আমরা এই আফ্রিকার পশুকে চিনি। তবে, শাহী বাংলার আন্তর্জাতিক ব্যবসার এক দারুণ উদাহরণ মালিন্দি থেকে আসা সেই জিরাফ যা চীনের নানজিং শহরে গিয়ে শেং ডু-র চিত্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।




Monday 5 October 2020

পশু কাহিনী-০১: ড্যুরারের আঁকা গণ্ডার

    ভারতীয় গরম মশলা—পঞ্চদশ শতাব্দীর পশ্চিম ইউরোপে এর দাম আজকের দামের চেয়ে ৪০ গুণ ছিল। ইতালীয়রা এই ভারতীয় গরম মশলার পাইকারি ব্যবসা করতো। ১৪৫৩-এ কনস্ট্যান্টিনোপেল, বা বর্তমান ইস্তানবুল, ক্রিস্টান রাজাদের হারিয়ে মুসলমান রাজারা অধিগ্রহণ করে নেয়। ইউরোপ ও এশিয়ার সীমান্তের এই শহর ছিল এই দুই মহাদেশের মধ্যেকার গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র। ক্রিস্টান ও মুসলমান রাজাদের বিবাদের জন্য এই দুই মহাদেশের মধ্যেকার ব্যবসা ধাক্কা খায়। ক্রিস্টান রাজারা এশিয়াি মহাদেশে পৌছোনোর নতুন পথ খুঁজতে থাকে। স্থল ছেড়ে জলে নামে ক্রিস্টান ব্যবসায়ীরা। ১৪৯৮-এ কেরলের কোরিক্কোড় শহরের কাছে এসে পৌঁছায় ভাস্কো দা গামার জাহাজ। সেই থেকে শুরু হয় জল-পথে ইউরোপ ও ভারতের মধ্যে আদান-প্রদান। কোরিক্কোড়-এ আস্তানা গড়তে না পেরে, কোরিক্কোড়-এর প্রতিপক্ষ কোচি-তে পর্তুগীজরা নিজেদের সাম্রাজ্য স্তাপন করে। দিউ দ্বীপের জন্য যুদ্ধে গুজরাটের মুসলমান রাজাদের হারানোর পর গোয়ায় পর্তুগীজরা নিজেদের রাজধানী গড়ে। ১৫১৪-তে পর্তুগীজরা খাম্বাটের সুলতান দ্বিতীয় মুজাফ্‌ফার শাহ-এর থেকে অনুমতি চায় দিউ দ্বীপে একটা কেল্লা স্তাপন করার জন্য। অনুমতি তারা পায় না। কিন্তু উপহারের মধ্যে পায় একটা হাতির দাঁতের কেদারা ও একটা ভারতীয় গণ্ডার ও সেই গণ্ডারের দেখাশোনার জন্য ওসেম নামক এক প্রশিক্ষকের।
    পর্তুগীজ গভর্নার আফোন্সো দে আলবুকুয়েরকে ভাবে যে পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েল-এর কাছে সে এই অদ্ভুত জীব যার ব্যপারে বহু কাল ধরে ইউরোপের মানুষেরা প্রাচীন রোমান পুঁথিতে পরে এসেছে কিন্তু দেখে নি, সেটি পাঠাবে এক দারুণ উপহার হিসেবে। জানুয়ারী ১৫১৫-তে ‘নসসা সেনিয়োরা দা আজুদা’ নামক একটা গরম মশলা বাহক জাহাজে করে গোয়া থেকে পর্তুগালে এই গণ্ডার, ওসেম নামক দেখাশোনার লোক ও গণ্ডারটির খাওয়ার জন্য বহু পরিমাণে চাল ও অল্প খড় পাঠানো হয়। তাজা ঘাস ও ফল খাওয়া পশুর জন্য চাল সেদ্ধ করে ভাত ও খড়-ই হয়তো লম্বা জাহাজ যাত্রার জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়েছিল। প্রায় চার মাস লাগিয়ে দেয় এই জাহাজ এই যাত্রা করতে। জাহাজটা টানা যাত্রা না করে মাঝে এই জলপথের তিনটি পর্তুগীজ ঘাঁটিতে থামে—মোজাম্বিক, সেন্ট হেলেনা ও আজোরেস। সেন্ট হেলেনা দ্বীপটি সেই যাত্রার তিনশো বছর পর বেশি বিখ্যাত আরেক অথিতিকে পায়—নেপোলিয়ান বোনাপার্ট।
    পর্তুগালের রাজধানী লিসবানে ২০শে মে নেমে গণ্ডারটিকে প্রথমে রাখা হয় নির্মীয়মাণ বেলেম দালানের কাছে এবং পরে রিবেইরা রাজপ্রাসাদের পশুশালাতে। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান পর্যটক ও ইতিহাসবীদরা পাণ্ডুলিপিতে লিখে গেছিল ভারতীয় এই অদ্ভুত পশুর ব্যপারে। এক সহস্রাব্দেরও বেশি পশ্চিম ইউরোপীয় কোন ব্যক্তি এই পশু দেখেছিলো না। গণ্ডার বা রাইনোসেরস এবং ইউনিকর্ণ—এই দুই পশুই ছিল বইয়ের গল্প। কোনটা সত্যি আর কোনটা নয়, কেউই ঠিক মত জানতো না। গণ্ডারটিকে দেখে জানতে পারলো যে অন্তত এই জীবটির অস্তিত্ব সত্যিই আছে। প্রাচীন লেখকেরা তাহলে ঠিকই বলেছিলো। এবার স্রেফ ইউনিকর্ণ-এর অপেক্ষা!
    প্রাচীন রোম থেকেই বিভিন্ন পশুদের একত্রিত করে তাদের একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে যুদ্ধ দেখার শখ মানুষেরা পোষন করে এসেছে। পশুর বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই বা দুই মানুষের লড়াই—এই সব শখের জন্য আলাদা নির্মাণ ও করা হত, যেরকম রোম এর কলোসিয়াম। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পশুরা এই সব প্রতিযোগিতা বুঝতে না পেরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো। খাওয়া বা নিজের জাতীর স্ত্রীলিঙ্গের পশুর সাথে যৌনমিলনের অধিকার পাওয়ার বাইরে পশু জাতির ভিতর মারপিট করার প্রবণতা কম। ফলে, মানুষেরা অনিচ্ছুক পশুদের খুঁচিয়ে বিরক্ত করে বা তাদের ভয়ানক ঘায়েল করে আরেক পশুর বা মানুষের সাথে ছেড়ে দিতো যাতে পশুরা ভাবতো অন্য পশুরা বা মানুষের ক্রীতদাসরাই তাদের শত্রু, অন্যান্য মানুষেরা নয়। প্রাণের ভয় নিজেকে বাঁচাতে এক পশু অন্য আরেক পশুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগতো। লাগুক যুদ্ধ, দে তালি।
    গণ্ডারটি লিসবানে আসার মাসখানেকের মধ্যেই ৩রা জুন, পারদের এক রবিবার, পর্তুগীজ রাজা একটা যুদ্ধের আয়োজন করলো। দুই বিরাট আকারের জীবের মধ্যে। এক দিকে এই গণ্ডার, আরেক দিকে নিজের পশুশালার একটা হাতি। প্রাচীন রোমান লেখক জ্যেষ্ট প্লিনি-র প্রাকৃতিক ইতিহাস নামক গ্রন্থে লেখা ছিলো যে গণ্ডার ও হাতি একে অপরের শত্রু। বইয়ের কথা মিলিয়ে নেওয়ার ও পশু লড়াইয়ের নৃশংস আনন্দ পাওয়ার এই সুযোগ রাজা হাতছাড়া করতে চায়নি। দুই বিরাট আকারের জীব। নিজেদের প্রাকৃতিক পরিবেশের বাইরে সময়ের সাথে কিছুটা মানিয়ে নিতে পারলেও এই কৃত্রিম বন্দোবস্ত বুঝতে পারছিলো না। মানুষের হৈহৈ, অন্যদিকে হয়তো অচেনা বা বহু আগে দেখা আরেক জীব। কী করবে বুঝতে না পেরে, হাতিটি একটি অবরুদ্ধ দ্বারের বেড়া ভেঙ্গে ভিতরের ধুকে গিয়েছিলো রাজার যুদ্ধ দেখার বন্দোবস্ত ভেস্তে দিয়ে।
    যুদ্ধ থেকে রেহাই পেলেও গণ্ডারটি শেষ যাত্রায় রেহাই পায়নি। তার কারণ মানুষের কৌতূহল ও গণ্ডারটির খ্যাতি। নানান ইউরোপীয় দেশ থেকে মানুষেরা গণ্ডারটিকে দেখতে আসে। একজন ইতালীয় ডাক্তার, জিয়োভানি জিয়াকোমো পেন্নি এই গণ্ডারটিকে নিয়ে একটা ছোট্ট পুস্তক প্রকাশ করে যাতে একটা চিত্র-ও আঁকে এই গণ্ডারটির। ভালেন্তিম ফের্নান্ডেস নামক জার্মান ভাষার এক মুদ্রাকর যে পর্তুগালেই থাকতো সে এই গণ্ডারটি দেখে একটি চিঠি লেখে জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে। আরেকজন আরেকটা চিঠি লেখে নুরেমবার্গে যেখানে এই গণ্ডারটার বর্ণনার সঙ্গে একটা চিত্র-ও আঁকে এই গণ্ডারটির। এই চিঠিটা নুরেমবার্গ শহরের বাসিন্দা অ্যালব্রেক্ট ড্যুরার নামক চিত্রকার দেখে। চিঠিটা এখন লন্ডনের ব্রিটিশ ম্যুসিয়াম এ দেখা যায়। ড্যুরার প্রায় একই রকম একটা চিত্র আঁকে।
    গণ্ডার পাঁচ প্রকারের। আফ্রিকার নামে সাদা কিন্তু আসলে ধূসর যাদের একটাই শিং থাকে; আফ্রিকার নামে কালো কিন্তু আসলে ধূসর যাদের দুটো শিং থাকে; ভারতীয় গণ্ডার যাদের গায়ে খাড়া দুটো দাগ থাকে, ঘাড়ের কাছে ও কোমরের কাছে; জাভা দ্বীপের এক প্রকারের ছোট আকারের ও সুমাত্রা দ্বীপের আরো ছোট আকারের আরেকটি প্রকারের।
    সেই চিঠির চিত্র ও ড্যুরারের চিত্র ভারতীয় গণ্ডারের বেশ ভালো অনুকরণ। গায়ে খাড়া দুটো দাগ থেকে তিনটি করে পায়ের আঙ্গুল। ড্যুরারের চিত্রে প্লিনি-র প্রাকৃতিক ইতিহাসের হাতি ও গণ্ডারের শত্রুতার গল্প ও লেখা আছে জার্মান ভাষায়। চিঠি ও ড্যুরারের চিত্রে গণ্ডারটির গা গোলাকার দাগে ভরা। হয়তো যে গণ্ডারটি লিসবানে পৌঁছেছিল, তার গায়ে কোন চর্মরোগ হয়েছিল। ড্যুরারের এই চিত্র কাঠে খোদাই করে কালিতে লাগিয়ে ছাপা হয়েছিল। যেহেতু কাঠের ছাঁচটা একবার বানালেই বহু বার কালি লাগিয়ে নানা চিত্র ছাপানো যায়, ফলে এই চিত্র বহু বার ছাপানো হয়েছিল এবং এই চিত্রটি ইউরোপে অল্প জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই জনপ্রিয়তাই সেই গণ্ডারটির আরো বড় সর্বনাশ ডেকে আনে।
    পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েল রোম এ পোপ বা ধর্মীয় পিতার থেকে অন্যান্য দেশে ব্যবসা করার অনুমতি চাইছিল। তখনকার পোপ-রা রাজনীতির ক্ষেত্রে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিল। তার অনুমতি পাওয়ার জন্য পোপকে খুশি রাখতে হতে। তার নানা কথা শুনতে হতো, তাকে নানা অর্থ ও উপহার দিয়ে নিজের দলে রাখতে হতো। ১৫১৪-তেই পর্তুগালের রাজা পোপ জিয়োভানি মেদিচি বা দশম লিওকে হান্নো নামক একটা হাতি পাঠিয়েছিল যেটাও ভারতের কোচি থেকে একই ভাবে লিসবানে এসছিলো যেমন ভাবে ১৫১৫-তে গণ্ডারটা এসেছিলো। সেই হাতি নিয়ে বিখ্যাত ইতালীয় চিত্রকার রাফায়েল একটা ছবি এঁকেছিলো। এই বছর এই গণ্ডারটি পাঠানোর ব্যবস্থা করলো রাজা, সঙ্গে ভারতের অনেক গরম মশলা। ১৫১৫-র ডিসেম্বারে হোয়াও ডে পিনা-র জাহাজে করে রোম যাওয়ার পথে দাঁড়ানো হলো ফরাসী মারসেঁই শহরে। ফরাসী রাজা ওই পথ দিয়ে যাত্রা করছিলো জানুয়ারী মাসে। বললো একবার গণ্ডারটাকে দেখবে। নামানো হলো গণ্ডারটাকে ফরাসী রাজার দর্শনের জন্য। আবার জাহাজে ওঠা হলো। ইতালীর কাছে জাহাজ আসার পর ঝড়ে জাহাজ ডুবে গেল। শেকল দিয়ে পা বাঁধা গণ্ডারটি জলে ডুবে মরে গেল। পরে গণ্ডারটির শবদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। লিসবানে ফেরৎ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল মরা গণ্ডার। বলা হয় যে শবটা পরিষ্কার করে খড় ভরে পরে ইতালীর ফ্লরেন্স শহরের যাদুঘরে রাখা হয়েছিল। তবে তার অস্তিত্ব এখন আর নেই।
    এখন এই গল্প জানা যায় কেবলমাত্র ড্যুরারের চিত্রের জনপ্রিয়তার জন্য। গরম মশলা থেকে গণ্ডার, আন্তর্জাতিক ব্যবসা থেকে সাম্রাজ্যবাদ, ইতিহাস ও তার সততা—এই গল্পেই মিশে আছে ইউনিকর্ণের গল্প ও জঙ্গলের গণ্ডারের বিপন্ন পরিস্থিতি।