বর্তমান মালদা জেলার পাণ্ডুয়ার গৌরবময় ইতিহাস বুঝতেে হলে ওখানকার ধ্বংসস্তূপ দেখতে হয়। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝখান পর্যন্ত শাহী বাংলার রাজধানী ছিল পাণ্ডুয়া। পরে রাজধানী গৌড়ে স্তানান্তারিত হয়, এবং পাণ্ডুয়া পরিত্যক্ত হওয়ায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। চীন দেশে তখন কুবলা খাঁ-র ইউয়ান রাজবংশের সাম্রাজ্য শেষ হয়ে হান রাজাদের মিং বংশের সাম্রাজ্য শুরু হয় নানজিং শহরকে কেন্দ্র করে। আফ্রিকার কেনিয়া দেশের প্রাচীনতম শহর, মোম্বাসা-র, থেকে ১০০ কি.মি. দূরে সমুদ্রতটেরই আরেক শহর মালিন্দি। মালিন্দি, পাণ্ডুয়া ও নানজিং—এই তিন শহরকে ১৪১৪ সালে জুড়ে ফেলেছিল একটি জিরাফ।
শাহী বাংলা তখনকার বস্ত্রশিল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। ভারতের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে ব্যবসা ছাড়াও, পশ্চিম দিকে আরব দেশ ও আফ্রিকার সঙ্গে, ও পূর্ব দিকে এশিয়ার অন্যান্য কিছু দেশ যেমন চীনের সঙ্গেও শাহী বাংলা ব্যবসা করতো। ব্যবসা রমরমা হলেও রাজনৈতিক স্তিতিশীলতা ছিলনা। ঘনঘন ইলিয়াস শাহী বংশের রাজা পরিবর্তন হচ্ছিল। এরকমই এক সময় এসে পৌঁছায় মালিন্দি থেকে আসা এক দল রাজদূত ও ব্যবসায়ীরা ইলিয়াস শাহী রাজার জন্য তোফা নিয়ে। একটি তোফা একখানা জিরাফ।
জিরাফ মানুষের পক্ষে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া একবিংশ শতাব্দীতেও কঠিন এবং মাঝে মাঝে পশুশালার আদান-প্রদানের মধ্যে জিরাফ হস্তান্তর করতে গিয়ে তারা মারা যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে যাত্রাটা আরো নিশ্চই কঠিন ছিল। আফ্রিকার বাইরে জিরাফ আগেও পাঠানো হয়েছিল। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টপূর্বে জিরাফ মাঝে মধ্যেই আফ্রিকা থেকে পাঠানো হতো। রোমান সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ততেও জিরাফ পাঠানো হতো। পশ্চিম এশিয়ার একাধিক এলাকায় প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সময়কার মোসেইকে পাওয়া যায় জিরাফের চিত্র। তবে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অবনতির পর, পশ্চিম ইউরোপে ত্রোয়দশ শতাব্দীর আগে আর জিরাফ দেখা যায়নি। প্রাচীন গ্রীস ও রোমের গ্রন্থে জিরাফের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সব গ্রন্থে এই পশুর নাম ছিল ক্যামেল-লোপার্ড, উঁট-চিতা বাঘ, কারণ পশুটি প্রথমটার মত লম্বা ও দ্বিতীয়টার মত তার গায়ে ছোপ।
ভারতবর্ষে জিরাফ প্রথম কবে আফ্রিকা থেকে আনা হয়, তার হদিশ পাওয়া মুশকিল। ত্রোয়দশ শতাব্দীতে নির্মিত কোনার্ক সূর্য মন্দিরের গায়ে জিরাফের খোদাইচিত্র দেখা যায়। তবে চীনে প্রথম জিরাফ নিয়ে যাওয়া হয়ে সেই ১৪১৪ সালেই। চীনের অভ্যন্তরিন সমস্যায় জর্জরিত মিং রাজারা চীনের বাইরের জগতের সঙ্গে ব্যবসায় খুব বেশি ইচ্ছুক ছিলনা। তবে পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে চীনের রাজা হয় শু দি যে ইয়ংলে নাম অবলম্বন করে। ইয়ংলে চীনের ইতিহাসে নানান পরিবর্তন ঘটায়। নানজিং থেকে বেইজিং-এ নিজের রাজধানী সরিয়ে আনে। সমুদ্র পথে ব্যবসা করার মহান পরিকল্পনা করে। চীনে বহুকাল ধরেই রীতি ছিলো শত্রুদের যৌনাঙ্গ কেটে দেওয়ার। এই অত্যাচার করা বালকদেরই আবার পরে মন্ত্রিসভায় জায়গা হতো। ভাবা হতো, এদের যেহেতু প্রজননক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছে, ফলে এরা রাজাকে টপকে নিজের রাজত্ব স্তাপন করার চেষ্টা করবে না কারণ তাদের কোনো উত্তরাধিকার থাকবে না। এরকম একজন বালক ছিল মা হে যাকে পরে রাজা নাম দিয়েছিল জেং হে। জেং হে রাজার সবচেয়ে বিশিষ্ট কর্মচারীরাদের মধ্যে জায়গা তৈরি করে নেয়ে। ১৪০৫ থেকে শুরু করে ১৪৩৩ পর্যন্ত জেং হে জাহাজে করে সাতখানা অভিযান চালায় পৃথিবীর নানা দেশে। সেই অভিযানের মাত্রা চীনের শক্তি ও মাপের সঙ্গে মানানসয়ী ছিল। সেই শতাব্দীর শেষে যখন ক্রিস্টোফার কোলাম্বাস যাত্রা শুরু করে, তার দলে ছিলো নব্বইয়ের কাছাকাছি মানুষ। জেং হে-র ছিল পয়ত্রিশ হাজার। জেং হে-র সব চেয়ে বড় জাহাজ কোলাম্বাসের সব চেয়ে বড় জাহাজের চেয়ে প্রায় কুড়ি গুন বড় ছিল। এরকমই এক চৈনিক অভিযান ১৪১৪-তে এসে পৌঁছায় বাংলার পাণ্ডুয়া তে। জেং হে-র মূল অভিযানের থেকে কিছু নাবিক আলাদা ভাবে পাণ্ডুয়া এসে পৌঁছোয়। সেখানে তখন মালিন্দি থেকে আসা জিরাফ-ও রয়েছে। সেই জিরাফ দেখে চীন থেকে আসা মানুষেরা হতভম্ব হয়ে যায়। চীন ও আফ্রিকার মধ্যে ক্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিলো ভারতের কেরলের থেকে ত্রোয়দশ শতাব্দীতে আফ্রিকার জিব্রা ও টোপি চীনের জাহাজে করে চীনদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে চীনের মানুষেরা আগে জিরাফ দেখেনি। তাদের প্রাচীন লোককথায় কিইলিন নামক এক পশুর কথা আছে (যা অনেকেই পাশ্চাত্যের ইউনিকর্ণের সঙ্গে জোড়ে)। এদের মনে হলো এই তো সেই কিইলিন! শিগ্গির নানজিং-এ মহারাজের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তবে মালিন্দির মানুষেরা তো এই জিরাফ ইলিয়াস শাহী বাংলার সুলতানকে দিয়েছিল। ফলে, বাংলার সুলতানকে বলা হলো যে এই পশু তাদের চীনের ধর্মে পবিত্র, যেমন পবিত্র ড্র্যাগান, ফিনিক্স ও কচ্ছপ। সুলতান চীন থেকে আসা যাত্রীদের তাদের রাজার জন্য এই তোফা পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু, চৈনিকরা ভাবলো আরেকটা জিরাফ হলেও মন্দ হয় না। ফলে, মালিন্দি থেকে আসা মানুষদের কাছে অনুরোধ জানানো হলো আরেকটা জিরাফের। জেং হে চীনে সেই বার ফেরৎ যাওয়ার পর, তার পরের যাত্রায় আফ্রিকা পর্যন্ত যায় এবং মালিন্দিতে যেতে ভোলেনি। ১৪১৪-এর এবং ১৪২১-এর চৈনিক যাত্রা থেকে চীনের নাবিকেরা নিজেদের রাজাকে দুই দুটো জিরাফ উপহার দিতে পেরেছিলো। প্রথম জিরাফটি পাওয়ার পরই রাজা ইয়ংলে এই অদ্ভূত জীবের একটি চিত্র বানিয়ে রেখেছিলো নিজের চারুলিপিকর শেন ডু-কে দিয়ে। সেই চিত্র আজ আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের এক যাদুঘরে। তবে, সেই চিত্র থেকে আফ্রিকা, বাংলা ও চীন-এর মধ্যে এক জিরাফ-যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
চিত্রটিতে দেখা যায় একটি জিরাফ ও তার দেখাশোনা করার এক লোককে। জিরাফের গায়ের দাগ ছোপ ছোপ না হয়ে, ত্রিকোণা ঢেউয়ের মত হয়ে গেছে। চীনের প্রবাদে যখনই কোন দয়ালু, শক্তিশালী ও ভালো রাজা থাকবেয়, স্রেফ তখনই কিইলিনের দেখা পাওয়া যাবে। চিত্রটি রাজশক্তির প্রমাণ—তাদের রাজার কাছে দুরূহ প্রাণীও আশ্রয় নেয়। সেই দুরূহ প্রাণীটিকে সাধারণ মানুষকেও চিনতে হবে। রাজা আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলো যে এই প্রাণীই কিইলিন, নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করার জন্য। কিইলিনকে ইউনিকর্ণের সঙ্গে একই ভাবে ভাবা হয়। ইউনিকর্ণ মানেই তার একটা শিং। তবে, জিরাফের দুটো শিং এবং শেন ডু-র চিত্রের জিরাফের-ও দুটো শিং। ফলে, জিরাফ-ই কিইলিন কি না চীনের মানুষের মধ্যে এই সংশয় থেকে থাকতেই পারে।
গণ্ডার ও জিরাফ—এই দুই পশুকেই কোন এক কালে ইউনিকর্ণ ভাবা হতো। এখন অনেকে বলে যে নারওয়াল নামক সামুদ্রিক জীবের শিং-কেই আগে অনেকে ইউনিকর্ণের শিং বলে চালাতো। গণ্ডার ভারতেও পাওয়া যায়, তাই আমরা এই পশুটিকে ইংরিজি নাম, রাইনোসেরাস, ছাড়াও অন্য নামে জানি। জিরাফ ভারতে ইংরেজদের আসার আগে থেকেই আরব ও আফ্রিকার মানুষেরদের থেকে আমরা চিনেছি। তবে জিরাফ ভারতে বহু কোটি বছর ধরেই পাওয়া যায় না। ফলে, জিরাফ চিরকালই ভারতে বিদেশী পশু। ইংরেজদের আসার পরই জিরাফ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে ভারতে আগের থেকে। ফলে, ইংরেজদের ব্যবহার করা নাম ধরেই আমরা এই আফ্রিকার পশুকে চিনি। তবে, শাহী বাংলার আন্তর্জাতিক ব্যবসার এক দারুণ উদাহরণ মালিন্দি থেকে আসা সেই জিরাফ যা চীনের নানজিং শহরে গিয়ে শেং ডু-র চিত্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
শাহী বাংলা তখনকার বস্ত্রশিল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। ভারতের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে ব্যবসা ছাড়াও, পশ্চিম দিকে আরব দেশ ও আফ্রিকার সঙ্গে, ও পূর্ব দিকে এশিয়ার অন্যান্য কিছু দেশ যেমন চীনের সঙ্গেও শাহী বাংলা ব্যবসা করতো। ব্যবসা রমরমা হলেও রাজনৈতিক স্তিতিশীলতা ছিলনা। ঘনঘন ইলিয়াস শাহী বংশের রাজা পরিবর্তন হচ্ছিল। এরকমই এক সময় এসে পৌঁছায় মালিন্দি থেকে আসা এক দল রাজদূত ও ব্যবসায়ীরা ইলিয়াস শাহী রাজার জন্য তোফা নিয়ে। একটি তোফা একখানা জিরাফ।
জিরাফ মানুষের পক্ষে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া একবিংশ শতাব্দীতেও কঠিন এবং মাঝে মাঝে পশুশালার আদান-প্রদানের মধ্যে জিরাফ হস্তান্তর করতে গিয়ে তারা মারা যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে যাত্রাটা আরো নিশ্চই কঠিন ছিল। আফ্রিকার বাইরে জিরাফ আগেও পাঠানো হয়েছিল। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টপূর্বে জিরাফ মাঝে মধ্যেই আফ্রিকা থেকে পাঠানো হতো। রোমান সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ততেও জিরাফ পাঠানো হতো। পশ্চিম এশিয়ার একাধিক এলাকায় প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সময়কার মোসেইকে পাওয়া যায় জিরাফের চিত্র। তবে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অবনতির পর, পশ্চিম ইউরোপে ত্রোয়দশ শতাব্দীর আগে আর জিরাফ দেখা যায়নি। প্রাচীন গ্রীস ও রোমের গ্রন্থে জিরাফের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সব গ্রন্থে এই পশুর নাম ছিল ক্যামেল-লোপার্ড, উঁট-চিতা বাঘ, কারণ পশুটি প্রথমটার মত লম্বা ও দ্বিতীয়টার মত তার গায়ে ছোপ।
ভারতবর্ষে জিরাফ প্রথম কবে আফ্রিকা থেকে আনা হয়, তার হদিশ পাওয়া মুশকিল। ত্রোয়দশ শতাব্দীতে নির্মিত কোনার্ক সূর্য মন্দিরের গায়ে জিরাফের খোদাইচিত্র দেখা যায়। তবে চীনে প্রথম জিরাফ নিয়ে যাওয়া হয়ে সেই ১৪১৪ সালেই। চীনের অভ্যন্তরিন সমস্যায় জর্জরিত মিং রাজারা চীনের বাইরের জগতের সঙ্গে ব্যবসায় খুব বেশি ইচ্ছুক ছিলনা। তবে পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে চীনের রাজা হয় শু দি যে ইয়ংলে নাম অবলম্বন করে। ইয়ংলে চীনের ইতিহাসে নানান পরিবর্তন ঘটায়। নানজিং থেকে বেইজিং-এ নিজের রাজধানী সরিয়ে আনে। সমুদ্র পথে ব্যবসা করার মহান পরিকল্পনা করে। চীনে বহুকাল ধরেই রীতি ছিলো শত্রুদের যৌনাঙ্গ কেটে দেওয়ার। এই অত্যাচার করা বালকদেরই আবার পরে মন্ত্রিসভায় জায়গা হতো। ভাবা হতো, এদের যেহেতু প্রজননক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছে, ফলে এরা রাজাকে টপকে নিজের রাজত্ব স্তাপন করার চেষ্টা করবে না কারণ তাদের কোনো উত্তরাধিকার থাকবে না। এরকম একজন বালক ছিল মা হে যাকে পরে রাজা নাম দিয়েছিল জেং হে। জেং হে রাজার সবচেয়ে বিশিষ্ট কর্মচারীরাদের মধ্যে জায়গা তৈরি করে নেয়ে। ১৪০৫ থেকে শুরু করে ১৪৩৩ পর্যন্ত জেং হে জাহাজে করে সাতখানা অভিযান চালায় পৃথিবীর নানা দেশে। সেই অভিযানের মাত্রা চীনের শক্তি ও মাপের সঙ্গে মানানসয়ী ছিল। সেই শতাব্দীর শেষে যখন ক্রিস্টোফার কোলাম্বাস যাত্রা শুরু করে, তার দলে ছিলো নব্বইয়ের কাছাকাছি মানুষ। জেং হে-র ছিল পয়ত্রিশ হাজার। জেং হে-র সব চেয়ে বড় জাহাজ কোলাম্বাসের সব চেয়ে বড় জাহাজের চেয়ে প্রায় কুড়ি গুন বড় ছিল। এরকমই এক চৈনিক অভিযান ১৪১৪-তে এসে পৌঁছায় বাংলার পাণ্ডুয়া তে। জেং হে-র মূল অভিযানের থেকে কিছু নাবিক আলাদা ভাবে পাণ্ডুয়া এসে পৌঁছোয়। সেখানে তখন মালিন্দি থেকে আসা জিরাফ-ও রয়েছে। সেই জিরাফ দেখে চীন থেকে আসা মানুষেরা হতভম্ব হয়ে যায়। চীন ও আফ্রিকার মধ্যে ক্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিলো ভারতের কেরলের থেকে ত্রোয়দশ শতাব্দীতে আফ্রিকার জিব্রা ও টোপি চীনের জাহাজে করে চীনদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে চীনের মানুষেরা আগে জিরাফ দেখেনি। তাদের প্রাচীন লোককথায় কিইলিন নামক এক পশুর কথা আছে (যা অনেকেই পাশ্চাত্যের ইউনিকর্ণের সঙ্গে জোড়ে)। এদের মনে হলো এই তো সেই কিইলিন! শিগ্গির নানজিং-এ মহারাজের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তবে মালিন্দির মানুষেরা তো এই জিরাফ ইলিয়াস শাহী বাংলার সুলতানকে দিয়েছিল। ফলে, বাংলার সুলতানকে বলা হলো যে এই পশু তাদের চীনের ধর্মে পবিত্র, যেমন পবিত্র ড্র্যাগান, ফিনিক্স ও কচ্ছপ। সুলতান চীন থেকে আসা যাত্রীদের তাদের রাজার জন্য এই তোফা পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু, চৈনিকরা ভাবলো আরেকটা জিরাফ হলেও মন্দ হয় না। ফলে, মালিন্দি থেকে আসা মানুষদের কাছে অনুরোধ জানানো হলো আরেকটা জিরাফের। জেং হে চীনে সেই বার ফেরৎ যাওয়ার পর, তার পরের যাত্রায় আফ্রিকা পর্যন্ত যায় এবং মালিন্দিতে যেতে ভোলেনি। ১৪১৪-এর এবং ১৪২১-এর চৈনিক যাত্রা থেকে চীনের নাবিকেরা নিজেদের রাজাকে দুই দুটো জিরাফ উপহার দিতে পেরেছিলো। প্রথম জিরাফটি পাওয়ার পরই রাজা ইয়ংলে এই অদ্ভূত জীবের একটি চিত্র বানিয়ে রেখেছিলো নিজের চারুলিপিকর শেন ডু-কে দিয়ে। সেই চিত্র আজ আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের এক যাদুঘরে। তবে, সেই চিত্র থেকে আফ্রিকা, বাংলা ও চীন-এর মধ্যে এক জিরাফ-যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
চিত্রটিতে দেখা যায় একটি জিরাফ ও তার দেখাশোনা করার এক লোককে। জিরাফের গায়ের দাগ ছোপ ছোপ না হয়ে, ত্রিকোণা ঢেউয়ের মত হয়ে গেছে। চীনের প্রবাদে যখনই কোন দয়ালু, শক্তিশালী ও ভালো রাজা থাকবেয়, স্রেফ তখনই কিইলিনের দেখা পাওয়া যাবে। চিত্রটি রাজশক্তির প্রমাণ—তাদের রাজার কাছে দুরূহ প্রাণীও আশ্রয় নেয়। সেই দুরূহ প্রাণীটিকে সাধারণ মানুষকেও চিনতে হবে। রাজা আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলো যে এই প্রাণীই কিইলিন, নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করার জন্য। কিইলিনকে ইউনিকর্ণের সঙ্গে একই ভাবে ভাবা হয়। ইউনিকর্ণ মানেই তার একটা শিং। তবে, জিরাফের দুটো শিং এবং শেন ডু-র চিত্রের জিরাফের-ও দুটো শিং। ফলে, জিরাফ-ই কিইলিন কি না চীনের মানুষের মধ্যে এই সংশয় থেকে থাকতেই পারে।
গণ্ডার ও জিরাফ—এই দুই পশুকেই কোন এক কালে ইউনিকর্ণ ভাবা হতো। এখন অনেকে বলে যে নারওয়াল নামক সামুদ্রিক জীবের শিং-কেই আগে অনেকে ইউনিকর্ণের শিং বলে চালাতো। গণ্ডার ভারতেও পাওয়া যায়, তাই আমরা এই পশুটিকে ইংরিজি নাম, রাইনোসেরাস, ছাড়াও অন্য নামে জানি। জিরাফ ভারতে ইংরেজদের আসার আগে থেকেই আরব ও আফ্রিকার মানুষেরদের থেকে আমরা চিনেছি। তবে জিরাফ ভারতে বহু কোটি বছর ধরেই পাওয়া যায় না। ফলে, জিরাফ চিরকালই ভারতে বিদেশী পশু। ইংরেজদের আসার পরই জিরাফ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে ভারতে আগের থেকে। ফলে, ইংরেজদের ব্যবহার করা নাম ধরেই আমরা এই আফ্রিকার পশুকে চিনি। তবে, শাহী বাংলার আন্তর্জাতিক ব্যবসার এক দারুণ উদাহরণ মালিন্দি থেকে আসা সেই জিরাফ যা চীনের নানজিং শহরে গিয়ে শেং ডু-র চিত্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।